ইসলামের নামে সন্ত্রাস (পর্ব ১) জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস কাকে বলে? এটা কি ইসলামে বৈধ?
জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, সমাজে প্রচলিত নিয়ম-কানুন, আইন, আদর্শ বা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের
লক্ষ্যে বে-আইনীভাবে প্রকাশ্যে বা গুপ্তভাবে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা। ইদানিং
জঙ্গি, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদী শক্তি
বোঝাতে ইংরেজীতে Militant,
Militancy ব্যবহৃত হয়। আরবীতে حربي (হরবী) বা محارب (মুহারিব) বলে।
অভিধানে এ সব শব্দের অর্থ ‘যোদ্ধা’, ‘সৈনিক’ বা ‘যুদ্ধে
ব্যবহৃত বস্তু’ লেখা হয়েছে। শক্তিমত্তা বা উগ্র বোঝাতেও এসব শব্দ ব্যবহৃত হয়।
মূলত: এগুলোর কোনোটিই বে-আইনী অর্থে ব্যবহৃত হত না। তাই বৃটিশ ইন্ডিয়ান কমান্ডার
ইন চিফকে “জঙ্গি লাট” বলা হত। স্বল্পকাল হলো,
এগুলো
বে-আইনী অর্থে ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ জন্য প্রকৃত শব্দ হলো ‘সন্ত্রাস’।
সন্ত্রাসের ইংরেজী শব্দ Terrorism (টেরোরিজম)। আধুনিক
আরবীতে ‘সন্ত্রাস’ বুঝাতে ‘ইরহাব’ (ارهاب) শব্দটি প্রসিদ্ধ লাভ করলেও কুরআন
শরীফে ও হাদীস শরীফের অধিকাংশ স্থানে ‘ফিতনা’ (فتنة) ও ‘ফাসাদ’ (فساد) শব্দ দ্বারা
সন্ত্রাসবাদকে বুঝানো হয়েছে।
সাধারণভাবে আমরা সন্ত্রাস বলতে বুঝি,
“কোনো
উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা”। এ অর্থে সন্ত্রাস ভালো মন্দ উভয় ক্ষেত্রে
সমানভাবে প্রযোজ্য। কারণ, ‘ভীতি সৃষ্টি’ ভালোর
জন্যেও হতে পারে; মন্দের জন্যেও হতে
পারে। অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও অপরাধীদের মনে ভীতি সৃষ্টি করাও উক্ত
অর্থে ‘সন্ত্রাস’। যদিও সন্ত্রাস বর্তমান শুধু মাত্র মন্দ কর্মের ক্ষেত্রেই
ব্যবহৃত হয়।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন পাকে ইরশাদ করেছেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآَخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
“তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং অন্যদেরকেও যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় কর
তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে। তোমাদের প্রতি অবিচার করা হবে না” (আনফাল
৬০)।
উক্ত আয়াতে শত্রুকে সন্ত্রস্ত করার ক্ষেত্রে ‘ইরহাব’ (ارهاب) শব্দ ব্যবহৃত
হয়েছে।
তবে মন্দ কর্মের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গা কী হবে- এ নিয়ে বর্তমান বিশ্বের
মনিষীগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-এ বলা হয়েছে,
“Terrorism: the systematic use of
violence to create a general climate of fear in a population and thereby to
bring about a particular political objective..”
“সন্ত্রাস : নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুশৃংখলভাবে
সহিংসতার ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠির মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরী করা।..”
উক্ত সঙ্গার আলোকে সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠির মাঝে সহিংসতার মাধ্যমে ভয়ের পরিবেশ
তৈরী করাও সন্ত্রাস। কাজেই উক্ত সঙ্গার আলোকে সন্ত্রাস নির্মূল করা সম্ভব নয়।
আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (এফ. বি. আই.) সন্ত্রাসের সঙ্গায়
বলেছে,
“The
unlawful use of force and violence against persons or property to intimidate or
coerce a government, the civilian population, or any segment thereof, in
furtherance of political or social objectives”
“কোনো সরকার বা সাধারণ নাগরিকদেরকে ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য
পূরণের জন্য ব্যক্তি বা সম্পদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা বা সহিংসতার বে-আইনি ব্যবহার।”
উক্ত সঙ্গায় বে-আইনিভাবে শক্তি ও সহিংসতার প্রয়োগকে সন্ত্রাস বলা হয়েছে। এর
দ্বারা বুঝা যায়, আইন সম্মত ভাবে শক্তি
প্রয়োগ করলে তা সন্ত্রাস হবে না। এখানে সমস্য হলো, আইন ও বে-আইন নির্ধারণ করা নিয়ে। একজনের দৃষ্টিতে একটা শক্তি প্রয়োগ আইন সম্মত, আরেকজনের দৃষ্টিতে সেটা বে-আইনি হওয়া স্বাভাবিক। ফলে
সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীকে নির্ণয় করা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সন্ত্রাসের সঙ্গা যে যাই দিক, প্রায় প্রত্যেকেই
সন্ত্রাস শব্দটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যত ক্ষুদ্র, অসহায় ও নিরাপরাধ জাতি হোক না কেন, প্রতিপক্ষ মনে করলেই তাকে গার জোরে সন্ত্রাসী বলে প্রচার
করা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে হামলা করা হচ্ছে।
স্পষ্ট করে বললে এটাই বলতে হবে যে,
অমুসলিমরা
সন্ত্রাস শব্দটিকে বর্তমান মুসলমানদের বিরুদ্ধেই কেবল ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনের
মুসলমানরা যখন স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে ইসরাইলী ইয়াহুদীরা তখন
তাদেরকে সন্ত্রাসী বলছে। বার্মার নিপীড়িত মুসলমানরা যখন আত্মরক্ষার চিন্তা করছে
বৈদ্ধরা তখন তাদেরকে সন্ত্রাসী বলছে। ভারত ও কাশ্মিরের নির্যাতিত মুসলমানরা যখন
নিজেদের মর্যাদার বাদী করছে হিন্দুরা তখন তাদেরকে সন্ত্রাসী বলছে। ইয়াহুদী
খ্রীষ্টান পরাশক্তিগুলো সন্ত্রাসের অপবাদে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরো অনেক স্বাধীন
দেশে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছে।
কাজেই এটা স্বীকার করতেই হবে যে, অমুসলিমদের কাছে
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গা আদৌ স্পষ্ট নয়। মুসলমানদের হাজার হাজার নারী শিশু মারা গেলেও
তা সন্ত্রস হয় না। আর মুসলমানদের হাতে তাদের কারো শরীরের একটা লোমকুপ উঠলেই সেখানে
লক্ষ লক্ষ টন বোমা মেরে জনপদকে নরকে পরিণত করা হয়। এর নাম সন্ত্রাস দমন নয়, বরং এর দ্বারা সন্ত্রাসকে উস্কে দেয়া হয়।
এ কারণে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ধারণা ইসলামই
সঠিকভাবে দিয়েছে। কুরআন, হাদীস, তাফসীর ও ইসলামী ফিকহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে বুঝে আসে যে, সন্ত্রাস হল,
“গুলু” তথা প্রত্যেক বিষয়ে শরীয়তের সীমা অতিক্রম করা।
আরেকটু বিশ্লেষন করলে এভাবে বলা যায় যে,
“ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ডের বাইরে ভয়ের পরিবেশ তৈরী, মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বা রক্তপাতের মাধ্যমে আল্লাহ
প্রদত্ব শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত
করা।“
সন্ত্রাসের উল্লেখিত সঙ্গার আলোকে কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, ‘ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ডের বাইরে’-একথা উল্লেখ করে উক্ত
সঙ্গায় শুধু মাত্র মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষন করা হয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মকে পাশ
কেটে যাওয়া হয়েছে।
আমরা বলব,
(ক) ধর্মের মানদণ্ড ছাড়া কখনো এ ধরনের
জটিল বিষয়ের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আর ইসলামই এমন এক ধর্ম, যা ঐশী ধর্ম হিসেবে অপরিবর্তিত অবস্থায় পৃথিবীর বুকে
চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উচূ শিরে দাঁড়িয়ে আছে এবং সৃষ্টিকর্তার বাণী প্রচার করছে।
(খ) ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্মের ধর্মগ্রন্থ
আল কুরআন-এর একটি হরফও পরিবর্তিত হয় নি এবং যে ধর্মের ধর্মগুরু মহানবী হযরত
মুহাম্মাদ (স.)-এর মুখনিশ্রিত বাণী শুরু থেকে সংরক্ষিত রয়েছে। পরবর্তীতে মহানবীর
বক্তেব্যের সাথে কেউ কোনো কথা জুড়ে দিয়ে সফলতা লাভ করতে পারে নি বরং তা
প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
(গ) ইসলামই পৃথীবির বুকে সর্বশেষ ধর্ম,
যে ধর্ম
পূর্বে প্রচলিত সকল ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে এবং অন্যান্য
ধর্মাবলম্বীদের সাথে (আচরণগত বিধান আরোপের দ্বারা) শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছে।
(ঘ) ইসলাম এমনই এক ধর্ম, যে ধর্ম গ্রহণে বাধ্য
বাধকতা না থাকার বিষয়টা সুনিশ্চিত এবং অন্যান্য সকল ধর্ম পালনের স্বাধিনতা সুবিদিত
ও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
(ঙ) ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা শুধু মাত্র
মুসলমান নয়, অন্য সকল ধর্মাবলম্বীসহ
পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাপ্য নিরাপত্তা ও অধিকার; সকল প্রাণীকুল, গাছ-পালা, তরু-লতা, ক্ষেত-খামার, মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, পানি-বায়ু ইত্যাদি সব
কিছুর নিরাপত্তা, অধিকার, সংরক্ষন ও স্বাধীনতা ক্ষেত্র অনুযায়ী নিশ্চিত করেছে।
এক কথায়, ইসলাম সকল ধর্ম-বর্ণের
মানুষের অধিকার নিশ্চিত করণসহ সব ক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তার বিধান দেওয়ায়
সন্ত্রাসের সঙ্গায় “ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ড”-এর কথা যুক্ত করাতে
অন্যান্য ধর্মকে পাশ কেটে যাওয়া হয় নি এবং শুধু মাত্র মুসলমানদের স্বার্থকে রক্ষা
করা হয়নি। বরং এর দ্বারা সকল ধর্ম-বর্ণ ও প্রাণীকুলের স্বার্থই রক্ষা হয়েছে।
ইসলামে সন্ত্রাসবাদ হারাম। দ্বিতীয় পর্বে (ইসলামে জিহাদের প্রকৃত মর্ম কি? জিহাদ ও জঙ্গীবাদের মাঝে কোনো পার্থক্য আছে কি? প্রশ্নের জবাবে) এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে (ইনশাআল্লাহ)।
অতএব ইসলামী যুদ্ধে রত মুজাহিদরা যদি জিহাদ করতে যেয়ে শরীয়তের সীমা অতিক্রম
করে অযোদ্ধাদের উপর আক্রমন করে, নারী ও শিশুদের উপর
হামলা করে তবে তা হবে সন্ত্রাস। অনুপযুক্ত অবস্থাকে জিহাদ বলে চালিয়ে দেওয়াও
সন্ত্রাস ও যমিনে অশান্তি সৃষ্টির নামান্তর।
অপরদিকে ইসরাইলী ইয়াহুদী কর্তৃক মুসলিম জনপদের উপর হামলা, নারী-পুরুষ, শিশু-যুবককে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, আটক, ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা
ইত্যাদি সন্ত্রাস। অথচ ইয়াহুদীবাদী এসব সন্ত্রাসের কামান ও গোলাবারুদের দিকে যারা
বাচার তাগিদে একটি ঢিল ছুড়ে মারে তাদেরকেই দুনিয়ায় সন্ত্রাসী বলে প্রচার করা হয়।
ইরাকের গণবিদ্ধংসী অস্ত্র নির্মূলের অজুহাতে স্বাধীন এ রাষ্টের উপর দুনিয়ার
সকল পরাশক্তির ঝাপিয়ে পড়া ও নিরাপরাধ মানুষের জান-মাল ধ্বংস করা সন্ত্রাস। আর একটা
সন্ত্রাস আরেকটি সন্ত্রাসকে জন্ম দেয়।
সংখ্যালঘু যে কোনো সম্প্রদায়ের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উপর অন্যায়ভাবে
অত্যাচার করা সন্ত্রাস। অতএব, বাংলাদেশে কোনো
সংখ্যালঘুর উপর বিনা অপরাধে ও আইনের বাইরে অত্যাচার করলে তা সন্ত্রাসের আওতাভূক্ত
হবে। চীন, বার্মা, ভারত ও অন্যান্য রাষ্ট্রেও সংখ্যালঘুদের উপর সীমাতিরিক্ত
অত্যাচারের খবর মাঝে মাঝে প্রচারিত হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত আগুনে মানুষ পুড়িয়ে
মারার কথাও মানুষের মুখে শোনা যায়। বাস্তব হলে এগুলো অবশ্যই সন্ত্রাস।
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলা নি:সন্দেহে সন্ত্রাস। যারাই করুক ইসলামী মানদণ্ডে এসব
হামলা অবশ্যই হারাম। আর প্রচলিত আইনে তো বৈধ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আরমিসহ যে কোনো
নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্য, কোট-কাচারী, বিচারক, উকিল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, চার্চ, হোটেল, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, যে কোনো পাবলিক প্লেসে হামলা করা সন্ত্রাসের অন্তর্ভূক্ত ও
হারাম। যুক্তি ও দলীল কোনোটা দিয়েই এর বৈধতা প্রমান করার সুযোগ নেই।
এসব করমকন্ডে লিপ্ত ব্যক্তিদের কুরআন হাদীস ও শরীয়তের মানদণ্ডের বিষয়ে কোনোই জ্ঞান নেই। পেট্রোল ও কেরোসিন তেলের পার্থক্য তারা বোঝে না। রাতের আঁধারে তারা লাকড়ি সংগ্রহ করতে যেয়ে গোখরা সাপকে নিজের বগলে তুলে নেই।
No comments